জানাজা নামাযের নিয়ম, নিয়ত ও ফজিলত |

মুসলিম মুর্দাকে সামনে রেখে নামাযের ন্যায়কাতার বন্দি হয়ে দাড়াতে হবে এবং মনে মনেজানাজার নামাজের নিয়ত করতে হবে।


ইমামসাহেব প্রথম তকবীরের পর আউযুবিল্লাহ ওবিসমিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতেহা পাঠ করবেন। 


(সাথেঅন্য ছোট কোন সূরা পড়া মুস্তাহাব,      
*ইমাম সাহেব দ্বিতীয় তাকবীর দিবেন।     
*এরপর দরুদে ইব্রাহিম পাঠ করবেন।      
*তৃতীয় তাকবীরের পর দোয়া পাঠ।      
*ইমাম সাহেব এরপর পর সালাম ফিরাবেন “আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” বলে।
      

জানাযা নামাযের নিয়ত

     
ﻧَﻮَﻳْﺖُ ﺍَﻥْ ﺍُﺅَﺩِّﻯَ ﻟِﻠَّﻪِ ﺗَﻌَﺎ ﻟَﻰ ﺍَﺭْﺑَﻊَ ﺗَﻜْﺒِﻴْﺮَﺍﺕِ ﺻَﻠَﻮﺓِ ﺍﻟْﺠَﻨَﺎ ﺯَﺓِﻓَﺮْﺽَ ﺍﻟْﻜِﻔَﺎﻳَﺔِ ﻭَﺍﻟﺜَّﻨَﺎ ﺀُ ﻟِﻠَّﻪِ ﺗَﻌَﺎ ﻟَﻰ ﻭَﺍﻟﺼَّﻠَﻮﺓُ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰِّﻭَﺍﻟﺪُّﻋَﺎ ﺀُﻟِﻬَﺬَﺍ ﺍﻟْﻤَﻴِّﺖِ ﺍِﻗْﺘِﺪَﺕُ ﺑِﻬَﺬَﺍ ﺍﻻِْﻣَﺎﻡِ ﻣُﺘَﻮَﺟِّﻬًﺎ ﺍِﻟَﻰﺟِﻬَﺔِ ﺍﻟْﻜَﻌْﺒَﺔِ ﺍﻟﺸَّﺮِ ﻳْﻔَﺔِ ﺍَﻟﻠَّﻪُ ﺍَﻛْﺒَﺮُ
      
উচ্চারণঃ

নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তায়ালা আরবাআ তাকরীরাতে ছালাতিল জানাযাতে ফারযুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।
      

অনুবাদঃ

আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে জানাযা নামাজের চারি তাকবীর ফরযে কেফায়া কেবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে আদায় করার মনস্থ করলাম। ইহা আল্লাহু তায়ালার প্রশংসা রাসূলের প্রতি দরূদ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া (আর্শীবাদ) আল্লাহ মহান।

জানাযার নামাজ ও তার ফযীলত 



যখন কোন মুসলমান মারা যায় তখন তার আত্মার শান্তির জন্য বিশেষভাবে কিছু দুআ করা হয়। ঐ বিশেষ প্রক্রিয়ায় দুআ করার নাম জানাযার নামাজ। 


এই নামাযের ফযীলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের জানাযায় শরীক হয়ে নামাজ পড়ে এবং তাকে কবরও দেয় সে দু কীরাত নেকী পায়। প্রত্যেক কীরাত উহুদ পাহাড় সমান নেকী। 


আর যে ব্যক্তি শুধু জানাযায় নামাজ পড়ে এবং মাটি দেয় না সে এক কীরাত নেকী পাবে (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, ১৪৪ পৃষ্ঠা)। 

জানাযার নামাজের জন্য অযু শর্ত 



জানাযার নামাজ শুরুর আগে পবিত্রা অর্জন করা আবশ্যক। অপবিত্র অবস্থায় জানাযা শুদ্ধ হবে না। ওজু কিংবা গোসল (যদি প্রয়োজন হয়) করে জানাযার নামাজে দাঁড়াতে হবে। 


কোথাও পানির ব্যবস্থা না থাকলে তায়াম্মুম করে নিতে হবে। বিখ্যাত তাবেয়ী নাফেঅ বলেন, আবদুল্লা ইবনু ওমর বলতেন, কেউ যেন বিনা অযুতে জানাযার নামায না পড়ে (মুঅত্তা ইমাম মালিক, ৮০ পৃষ্ঠা)। তবে হ্যাঁ, অযু করতে গিয়ে জানাযা যদি ছেড়ে যাবার আশংকা থাকে তাহলে ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, তুমি তায়াম্মুম কর এবং নামাজ পড় (মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, ৩য় খণ্ড, ৩০৫ পৃষ্ঠা)। 

লাশ ও ইমামের অবস্থান কিরূপ হবে? 



সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রা.) বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহর পেছনে একটি মেয়ের জানাযা পড়ি। তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাশের মাঝ বরাবর দাঁড়ান (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ১৪৫ পৃষ্ঠা)। 

মুক্তাদীদের লাইন কটা হবে? 



মালিক ইবনু হোরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যে মুসলমানের মরার পর তার জানাযায় মুসলমানদের তিন লাইন লোক নামাজ পড়ে তার জন্য (আল্লাহতা’য়ালা ক্ষমা) অপরিহার্য করে দেন। 


তাই জানাযা ইমাম মোক্তাদীর সংখ্যা যখন কম মনে করতো তখন মালেক (রা.) এই হাদীসটির ভিত্তিতে তিনটি লাইন করে নিতেন (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজা, মিশকাত, ১৪৭ পৃষ্ঠা)। 

মুসল্লী সংখ্যা কত হওয়া উচিত? 



রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন মুসলমানের জানাযায় এমন চল্লিশজন লোক যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেননি যদি শরীক হয়ে ঐ লাশের জন্য দুআ করে তাহলে আল্লাহতা’য়ালা তাদের সুপারিশ নিশ্চয়ই কবুল করবেন (মুসলিম, মিশকাত, ১৪৫) 

আত্মহত্যাকারী, বেনামাযী ও ফাসেকের জানাযা 



জাবের বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে একজন আত্মহত্যাকারীর লাশ আনা হলে তিনি তার জানাযা পড়েননি (মুসলিম, বুলুগুল মারাম, ৩৯ পৃষ্ঠা)। 


এইরূপ জোহায়না গোত্রের এক ব্যক্তি খায়বারের দিনে গনীমতের (জেহাদেলব্ধ) মাল চুরি করায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা না পড়ে বলেন, তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়ে নাও (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)। 


উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ওলামায়ে কিরাম বলেন, আত্মহত্যাকারী এবং চোর ও ডাকাতের জানাযা আলেম ও পরহেযগার লোক না পড়ে সাধারণ লোক পড়বে। যাতে অন্যান্য লোকেরা সাবধান হয়ে যায় এবং শিক্ষা পায়। 

গায়েবী জানাযা 



আবিসিনিয়ার বাদশাহ আসহিমাহ নাজ্জাশী যেদিন মারা যান সেদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে ঐ মৃত্যু সংবাদ দিয়ে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে গিয়ে গায়েবী জানাযা পড়েন (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ১৪৪ পৃষ্ঠা)। 


ইমাম ইবনু হাযম বলেন, এই হাদীস প্রমাণ করে যে, জামায়াত সহকারে গায়েবী জানাযা পড়া সাহাবায়ে কিরামের ইজমা বা সর্ববাদীসম্মত অভিমত। এর খেলাফ করা বৈধ নয় (মুহাল্লা, ৫ম খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা)। 


আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ যাইলায়ী হানাফী (রহ.) বাইহাকী এবং ওয়াকিদীর কিতাবুল মাগা-যীর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূতা যুদ্ধের দুই শহীদ রাসুলুল্লাহ পালক পুত্র যায়দ ইবনু হা-রিসাহ এবং আলীর বড় ভাই জাফর ইবনু আবী তা-লিবের গায়েবী জানাযা পড়েছিলেন (নাসবুর রা-য়াহ ২য় খণ্ড, ২৮৪ পৃষ্ঠা)। 

মসজিদে জানাযার নামায চলে কিনা? 



আয়েশা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইযার দুই পুত্র সুহাইল এবং তার ভাইয়ের জানাযা মসজিদে পড়েছিলেন (মুসলিম, মিশকাত, ১৪৫ পৃষ্ঠা)। 


আর এক মুহাদ্দিস আল্লামা যাইলায়ী বলেন, ঐরূপ হাদীস ইবনু আদীর আলকা-মিলেও আছে। কিন্তু ইমাম নবভী বলেন, ঐ সব হাদীসই যয়ীফ। যা দলিল যোগ্য হতে পারে না। (নাসবুর রা-য়াহ ২য় খণ্ড, ২৭৫-২৭৬ পৃষ্ঠা)। 


মোসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা এবং সুনানে সায়ীদ ইবনু মনসুরে আছে যে, ওমর আবু বাক্রের জানাযা মসজিদে পড়েছিলেন (হাশিয়া দেহলঅবী আলা-বুলুগুল মারা-ম, ১ম খণ্ড, ২৯৩ পৃষ্ঠা)। 


এ ব্যাপারে হাফেয ইবনুল কাইয়েম বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই মসজিদের বাইরে পড়তেন এবং কখনো কখনো মসজিদের ভেতরেও পড়েছেন। দু’রকমই জায়েয। তবে অসুবিধা না হলে মসজিদের বাইরে পড়াটাই উত্তম (যা-দুল মাআ-দ, ১ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা)। 

জানাযার ইমাম কে হওয়া উচিত? 



মাইয়েত যদি জীবদ্দশায় তার জানাযা পড়াবার জন্য কাউকে অসিয়্যত করে থাকে তাহলে সেইই জানাযা পড়াবে।


 যেমন-আবুবাকর ওমরকে, ওমর সুহাইবকে এবং তার পুত্র হাযেরকে, ইবনু মসউদ ইবনু যুবায়রকে এবং আয়েশা আবু হুরায়রাকে তাদের জানাযা পড়াবার জন্য অসিয়্যত করেছিলেন। তাই তারাই জানাযা পড়িয়েছিলেন। ফলে এটা ইজমায় পরিণত হয় (আসইয়লাহ, ১ম খণ্ড, ২৬৫ পৃষ্ঠা)। 


ইমাম নবভী বলেন, অসিয়্যতের পর অলী বা মাইয়েতের ঘনিষ্ট আত্মীয় জানাযা পড়াবে। তারপর মসজিদের ইমাম। ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে প্রথমে পিতা, তারপর দাদা, তারপর পুত্র, তারপর পৌত্র, তারপর ভাই (রওযাতুত তলিবীন, ২য় খণ্ড, ১২১ পৃষ্ঠা)। 

জানাযার নামাজের সময়ের করণীয়ঃ



এই পৃথিবীতে জীবন চলার পথে প্রত্যেক মানুষই ভাল-মন্দ নিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হন। ভুলের ঊর্ধ্বে কেউ এই নশ্বর পৃথিবীতে নেই। 


সেজন্য কোন মানুষের মৃত্যু খবর শোনামাত্র তার ভুল-ত্রুটিগুলো সবারই ক্ষমা করে দেয়া উচিত। মৃত ব্যক্তি যদি কারো কাছে ঋণ থাকেন তাহলে তার ওয়ারিশগণ পরিশোধ করে দেবেন। আর যদি তারা অসচ্ছল হয় ও ঋণদাতা স্বচ্ছল হন তাহলে ক্ষমা করে দেয়াই হবে মহোত্তম কাজ। 


এক স্থানে জানাযা পড়তে গিয়ে একটি অভিনব ঘটনার সূত্রপাত হলো। সবাই জানাযা নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন সময় ইমাম সাহেব বলছেন, মৃত ব্যক্তির কত ওয়াক্ত নামাজ কাযা গিয়েছে? পরিবারের লোকজন সঠিক হিসাব দিতে পারছিলেন না। 


ইমাম সাহেব বললেন, যত ওয়াক্ত নামাজ কাযা গিয়েছে তা হিসাব করে কাফফরা না দিলে জানাযা নামাজ পড়ানো যাবে না। 


এভাবে সময়ক্ষেপণ করায় উপস্থিত মুসল্লিরা বিব্রত হচ্ছিলেন। আসলে ঐ বিষয়টি ইমামের পরিষ্কার জানা নেই যে জানাযা আটকিয়ে রেখে নামাজের কাফফারা আদায় করার কোন বিধান কুরআন হাদীসে নেই। 


কারণ যতক্ষণ মানুষের সেন্স থাকে ততক্ষণ ইশারায় হলেও নামাজ পড়তে হবে। আর কাযা হলে কাযা আদায় করবেন। 


আর যার কাযা আদায় করা সম্ভব হয়নি তিনি তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এর জন্য তাকে কোনো কাফফারা দেয়ার প্রয়োজন নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top